আগামী লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি কি অপ্রতিরোধ্য থাকবে, এটাই রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে চর্চার বিষয়। বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, এমন কোনও জাতীয় রাজনৈতিক দলকেই দেখা যাচ্ছে না। কংগ্রেস যে সব কঠিন অসুখে ভুগছে, এখন অবধি রোগ নিরাময়ের কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নানা কূটকৌশল প্রয়োগ করে বিজেপি জনসমক্ষে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কেন্দ্রে একনাগাড়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা নেহাতই সময়ের অপেক্ষা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যেভাবে নীল নকশা তৈরি করে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন, বিরোধী দলের নেতারা সেটা ঠাহর করতে পারছেন কি না, এটাও বড় প্রশ্ন। বিজেপির কাছে স্বস্তির বিষয় এটাও যে, বিরোধী দলগুলো কোনও রণনীতি তৈরি করে ময়দানে ঝাঁপাতে পারছে না।
বিরোধীপক্ষের একটা বড় অংশই কেন্দ্র থেকে বিজেপি সরকারকে হটানোর কথা বারবার বলছেন,কিন্তু কী ভাবে সেটা সম্ভব এর কোনও রূপরেখা তৈরি করতে পারছেন না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশজুড়ে গণ-আন্দোলন সংগঠিত করার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারছে না বিরোধীপক্ষ। মাঝেমধ্যে এ রাজ্যে সে রাজ্যে সমাবেশ করে জনগণকে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও কাজের কাজ হচ্ছে কোথায়? এখন পর্যন্ত একটাই সমীকরণ, আঞ্চলিক দলগুলোর সম্মিলিত শক্তিতে বিজেপিকে পরাস্ত করা। কিন্তু ইডি-সিবিআই জুজুতে তাঁরা এত বেশি তটস্থ যে,কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামতে পারছেন না। পাশাপাশি বিজেপি ভাঙনের খেলায় এত বেশি সিদ্ধহস্ত যে, ক্ষমতায় থাকা রাজ্যের গদি সামলাতেই তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজেপির সাঁড়াশি অভিযানের মোকাবিলা করাও তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতা হারানোর পর এই দীর্ঘ সময়েও কংগ্রেস কোনও সাংগঠনিক রূপরেখা তৈরি করতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে এই দলটি। সবচেয়ে বড় কথা, আত্মবিশ্বাসে প্রবল চিড় ধরেছে কংগ্রেস নেতাদের। কংগ্রেসই একমাত্র দল সারা দেশে দীর্ঘকাল ধরে যাদের সংগঠন রয়েছে। কিন্তু সেই সংগঠনকে কাজে লাগানোর মতো নেতা কংগ্রেসে কোথায়? ফলে রাজ্যে রাজ্যে দলটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মূলত, ২০০৪ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিজেপি তথা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে হারিয়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা দখল করাটাই ছিল অনেকটা অপ্রত্যাশিত। প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া যে এত তীব্রতর, বাজপেয়ীরা এর বিন্দুবিসর্গ টের পাননি। ফলে নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রমোদ মহাজন – এর মতো বিজেপি নেতাদের অত্যধিক আগ্রহে হয়েছিল ওই অকাল নির্বাচন।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বিকল্প হিসেবে লালকৃষ্ণ আডবাণীকে লৌহপুরুষ আখ্যায়িত করে ময়দানে নামিয়েছিল বিজেপি। আডবাণী তখন ছিলেন দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী। এরপর বিজেপি যখন অনেকটা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল, তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই দলে কার্যত নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেন। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার আগেই বিজেপি কর্পোরেট ধাঁচে পরিচালিত হতে থাকে। সেই অভিমুখ ধরেই দশ বছরের মেয়াদ অতিবাহিত করছে মোদি সরকার। মুক্ত অর্থনীতিতে অবগাহন করে এই সরকার যে ভাবে দেশ পরিচালনা করছে ,তাতে জনগণের একাংশ তুষ্ট থাকলেও অন্যরা কিন্তু রুষ্ট। তবে জন মোহিনী কিছু প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মানুষের যথেষ্ট আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে মোদি সরকার। এই সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানত যে অভিযোগ তা হল,বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ এবং নানা ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি নীতির প্রশ্নে চরম অসহিষ্ণুতা। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহ জুটি ফের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করতে কোনও ফাঁকফোকর রাখতে চাইছেন না। তবে এটা তাঁরা ভালো করে জানেন যে, ভোটের কূটকৌশলে কিছু ভুল ত্রুটি হলে ২০০৪ সালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। কারণ ,ইতিহাস বলছে, ভোটের রাজনীতিতে ভারতের মানুষের মন বোঝা বড় কঠিন।বিজেপি যখন সর্বতোভাবে ভোটের অংক কষে যাচ্ছে ,তখন বিরোধী দলগুলো কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায়। সবচেয়ে বড় সমস্যা্য হলো ,কংগ্রেস ছাড়া জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী দল নেই। বিজেপি উৎখাতে আঞ্চলিক দলগুলির সম্মিলিত শক্তিই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সকলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তিত্ব কোথায়? এক সময় দেশে যখন কংগ্রেসের রমরমা কর্তৃত্ব ছিল তখন তাদের গদিচ্যুত করতে বিরোধীরা একমঞ্চে উপনীত হতেন। বিরোধীদের মধ্যে জনপ্রিয় নেতা তখন অনেকেই ছিলেন,যারা মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার মতো অবস্থানে ছিলেন। বর্তমানে আঞ্চলিক দলগুলির বহু নেতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হলেও মোদি সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় স্তরে আলোড়ন তৈরি করতে পারেননি। নিজ নিজ রাজ্যে তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকলেও বাইরে এসে তেমন কিছু করতে পারছেন না। বিজেপি বিরোধী ভূমিকায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অত্যন্ত সরব।কিন্তু নিজ রাজ্যে তিনি এত বেশি জেরবার যে,অন্যত্র গিয়ে কিছু একটা করতে পারছেন না।
নবতম সমীকরণে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, জনতা দল (ইউনাইটেড) নেতা নীতীশ কুমার বিরোধীদের মুখ হিসেবে প্রচারের আলোয় আসতে চাইছেন। পাঞ্জাব বিজয়ের পর আম আদমি পার্টি নেতা, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুজরাটে বিশেষ মনোনিবেশ করেছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে একের পর এক তোপ দেখে চলেছেন তিনি। নীতীশ কুমার এই সেদিন পর্যন্ত বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, তাই জনমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে নিশ্চিতভাবেই তাঁর কিছুটা সময় লাগবে।এ ছাড়া, এই মুহূর্তে বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী,ডিএমকে নেতা এমকে স্টালিন,তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী টিআরএস প্রধান কে চন্দ্রশেখর রাও, ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী জেএমএম প্রধান হেমন্ত সরেন,বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় জনতা দল নেতা তেজস্বী যাদব সহ এনসিপি প্রধান,মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শরদ পওয়ার,শিবসেনা প্রধান, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে, সমাজবাদী পার্টি প্রধান, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব,বহুজন সমাজ পার্টি প্রধান, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কুমারী মায়াবতী,তেলেগু দেশম পার্টি প্রধান ,অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডু,ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা জম্মু-কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাহ এবং ওমর আব্দুল্লাহ,জনতা দল (সেক্যুলার) নেতা কর্নাটকের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়া এবং এইচডি কুমারস্বামী সহ অন্যরা। সিপিআইএম, সিপিআই এবং সব বামপন্থী দল কট্টর বিজেপি বিরোধী। এ দিকে,অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী,ওয়াইএসআর কংগ্রেস প্রধান বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় রয়েছেন। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীর বিজু জনতা দল প্রধান নবীন পট্টনায়েক রয়েছেন মাঝামাঝি অবস্থানে, বলা যায় বিজেপির দিকে কিছুটা ঝুঁকেই।এআইইউডিএফ এর মতো কিছু ছোট দল রয়েছে এ দিকে সে দিকে। অনেকটা লাভালাভের অংক কষে চলা। বস্তুত, এতগুলি আঞ্চলিক দলকে একাসনে বসিয়ে বিজেপি বিরোধিতার ক্ষেত্র তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।সনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি।
এক সময় কংগ্রেসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধীদের এককাট্টা হতে হতো। শাসনযন্ত্রের অভিমুখ পাল্টে যাওয়ার পর এখন বিজেপি- বিরোধী সবাইকে হাতে হাত মেলাতে হচ্ছে ।আর এখানেই থেকে যাচ্ছে বিশ্বাস- অবিশ্বাসের বাতাবরণ । বিভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী দলগুলির এক মঞ্চে উপনীত হওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। অভিন্ন কর্মসূচির বিশল্যকরণী প্রয়োগ করেও অতীতে বিপর্যয় ঠেকানো যায়নি , জোট সরকার ভেঙে খান খান হওয়ার নজির কিন্তু রয়েছে। এখানেই দেশের মানুষের বিরোধীদের নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সংকোচের আবহ। বিভিন্ন কারণে বিজেপি সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ ধূমায়িত হলেও বিকল্প উৎস সন্ধানে স্পষ্ট ছবি কোথায়? জয় প্রকাশ নারায়ণ , মোরারজি দেশাই, চৌধুরী ঢরণ সিং ,জগজীবন রাম,বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং,অটল বিহারি বাজপেয়ী , ইন্দ্রকুমার গুজরাল,এইচডি দেবেগৌড়া,এম করুণানিধি,এন চন্দ্রবাবু নাইডু,মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব ,মধু দণ্ডবতে,প্রমীলা দণ্ডবতে,লালকৃষ্ণ আডবাণী প্রমুখ নেতারা যে ভাবে বিভিন্ন সময়ে দিল্লির পটপরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন,এ রকম বিক্রিয়া এখন কোথায়?
বিরোধীরা ক্ষমতায় বসলে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোর লোক হয়তো কম মিলবে না,কিন্তু এর আগে নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসেবে কাউকে তুলে ধরা খুবই কঠিন কাজ। কার্যত ,এই জায়গাতেই আটকে রয়েছে বিরোধীদের গতিবিধি। এই প্রেক্ষাপটে লক্ষ্যভেদের ধনুক হাতে নিয়ে কে বা কারা, কী ভাবে অগ্রসর হবেন,এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।