উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক’টি রাজ্য এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর করিডর হিসেবে বরাক উপত্যকার অপরিসীম ভৌগলিক গুরুত্ব রয়েছে । ভারতের শেষ সীমান্ত হিসেবে এ অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিল ব্রিটিশ শাসকরা । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও  আন্তঃরাষ্ট্র যোগসূত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বরাক উপত্যকা স্বাধীন ভারতে কিন্তু যথেষ্ট উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে । এর পরিবর্তে এখানকার ভূমি কার্যত আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি ও পাচারচক্রের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে । এই অঞ্চলকে ব্যবহার করে কী কী দ্রব্যাদি এবং কোন কোন জীবজন্তু পাচার করা হচ্ছে, সরকারি পরিসংখ্যানে  তার  তথ্য  নেই । বলা যায়, যথাযথ নজরদারি থাকলে এ উপত্যকা এই ভাবে অপরাধীদের মৃগয়াক্ষেত্রে  পরিণত হতো না। এ সব কথা সব সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল মহলে চর্চিত হয়।

বরাকে রাজপথের বুক চিঁরে অবৈধ সামগ্রী নিয়ে শত শত লরি কিংবা অন্যান্য যানবাহন অবাধে গন্তব্যস্থলে চলাচল করছে ।কয়লা থেকে শুরু করে বার্মিজ সুপারি, সার থেকে চুনাপাথর, পোস্ত থেকে প্রক্সিবন, ক্যাঙ্গারু থেকে ওরাংওটাং,পাথর থেকে ড্রাগস-বরাকের পথ ধরেই চোরাকারবারের রমরমা বাজারে দেশে-বিদেশে হাতবদল হচ্ছে সব কিছুই ।

প্রবাদ আছে, ” কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।” কালো হিরে  নিয়ে কোলিয়ারি অঞ্চলে নানা জমজমাট কাণ্ড-কারখানার কথা কে না জানেন। সে এক অন্য জগত! বরাক উপত্যকাযও  কয়লা- কথা নিয়ে আসর বেশ সরগরম । কয়লার কালো ছোপছোপ দাগ এখানকার যত্রতত্র প্রসারিত । কোনও কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে কয়লা সহ নানা রকম অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক হওয়ার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে । শুধু শাসক দল নয় ,বিরোধীপক্ষের প্রভাবশালী কারও কারও গভীর সমঝোতা রয়েছে রাতারাতি ধনকুবের হয়ে যাওয়ার এই কালো – বৃত্তান্তে। 

“সিন্ডিকেট” বলে কথা! মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পার্বত্য  জেলা থেকে কয়লা বোঝাই লরি-র এক বড় অংশই বরাকের রাজপথ ধরে চলাচল করে । কাটিগড়া সীমানা পেরিয়ে মেঘালয় প্রবেশ করলেই রাতাছড়া,উমকিয়াং – এ দেখা যায় কয়লার ভাঁড়ার।মেঘালয়ের খাসি – মিকির – গারো পার্বত্য জেলাগুলোতেও রয়েছে বহু অমূল্য কয়লা- সম্পদ । এ সব কয়লা-খনির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পঁচিশটি নথিভূক্ত কোম্পানি ।কিছু শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন উৎপাদনের জন্য কয়লা একেবারেই অপরিহার্য । বরাক উপত্যকা দিয়ে মেঘালয় থেকে  কয়লা বোঝাই লরি এক দিকে যেমন ত্রিপুরাতে যায়, অন্য দিকে গন্তব্যস্থল  বাংলাদেশ।বরাক উপত্যকাযও চা বাগিচা শিল্প ,ইটভাটা ,রড ফ্যাক্টরি ,একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য কয়লার প্রয়োজন । এ সব ক্ষেত্রে মূলত পরিবহণ বিধি মেনে এবং জিএসটি প্রদান করে কয়লা আনার কথা।ত্রিপুরা রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক  আমদানি-রফতানি নীতি ও বিধি কার্যকর । বাংলাদেশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান তো বটেই ,তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত হয় প্রচুর কয়লা ।নিজেদের কয়লা-খনি থাকলেও চাহিদা পূরণ সম্ভব নয় । প্রয়োজনীয় চাহিদার জন্য বিশেষত  ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশে কয়লা আমদানি করা হয়ে থাকে । অথচ করিমগঞ্জ জেলার সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে বরাবর  চলছে কয়লার রমরমা বাজার।রাজপথ কাঁপিয়ে একের পর এক কয়লাবাহী লরি বাংলাদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি বৈধতা কতটুকু রয়েছে, এ নিয়ে অবশ্যই প্রশ্নচিহ্ন  থাকছে ।

কয়লার মহিমায় রাতারাতি ধনকুবের হয়ে যাওয়ার খবরাখবর নেহাত নতুন নয় । দীর্ঘকাল ধরেই চলছে এ সব। কোলিয়ারি অঞ্চলে কয়লা- মাফিয়াদের দাপটের কাহিনি বহু চর্চিত । প্রভাবশালী দুর্নীতিগ্রস্ত  রাজনৈতিক জগতের সঙ্গে কয়লা-মাফিয়াদের নিবিড় যোগসাজশের  কথা সুবিদিত । দেশ জুড়েই কম-বেশি এই চিত্র। এরই মধ্যে সংবাদ শিরোনামে ফলাও করে  বারবার আসছে বরাক উপত্যকায় কয়লা সিন্ডিকেট-এর কথা। কিছু শাসক বিজেপি নেতার নাম ধরে ধরে উল্লেখ করা  হচ্ছে । কখনও কখনও আবার কয়লা- বোঝাই লরি ধরে ফেলছে পুলিশ। নানা সূত্র ধরে প্রকাশ্যে আসছে সিন্ডিকেটের সরগরম গল্পগাথা। সিন্ডিকেটের পালাবদলে বিভিন্ন মহলে  নানা সময়ে আনন্দ – বিষাদের ছায়া! 

মেঘালয় সীমানা অতিক্রম করে কয়লাবোঝাই লরি কাটিগড়া বিধানসভা কেন্দ্রের মালিডহর, কালাইনছড়া, লক্ষীছড়া, শিবনগর, দুর্গানগর,দিগরখাল, গুমড়া, ভাটপাড়া, কালাইন, কাটিগড়া এলাকা পার করে বদরপুর হয়ে করিমগঞ্জ জেলাসদরে পৌঁছে । এর পর ত্রিপুরাগামী লরি পাথারকান্দি হয়ে এবং বাংলাদেশ চলাচল করে সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে।মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার কড়া “ফরমান” জারি হওয়ার পর পুলিশের সঙ্গে সিন্ডিকেটের “লুকোচুরি” পর্বে ধরপাকড়ের  ঘটনা ঘটে চলেছে। “রুদ্ধশ্বাসকর এনকাউন্টার” – এর দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে।কিন্তু বাস্তবের জমিতে এখন অবধি “কাজের কাজ” কতটুকু হয়েছে , এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। 

সচেতন মহলের মতে, কাছাড়-করিমগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পেরিয়ে অবৈধ কয়লাবোঝাই  লরিগুলো কী ভাবে যথাস্থানে পৌঁছে যায়, এটাই সরকার তথা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। পুলিশ, পরিবহণ বিভাগ থেকে শুরু করে এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যে সব নজরদারি সংস্থা রয়েছে, তারা কি এ ক্ষেত্রে যথাযথ দায়িত্ব পালনে অপারগ? রাঘব-বোয়ালরা  যে নীল নকশা তৈরি করে পাচারচক্রের বড় সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তাতে সরকারি প্রশাসনযন্ত্র এবং বিভিন্ন নিয়ামক সংস্থা কি মুখ থুবড়ে পড়েছে ?স্বাভাবিকভাবেই তাদের দিকে এই প্রশ্ন তাক করে আছে । পঞ্চায়েত – পুরসভার বহু প্রতিনিধি ছাড়াও বরাক উপত্যকায় এক জন মন্ত্রী, ১৪ জন বিধায়ক, দু’জন লোকসভা সদস্য রয়েছেন। আশ্চর্যজনকভাবে, এ নিয়ে  মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন সবাই । সরকারি পর্যায়ে কোনও রূপ সবুজ সঙ্কেত ছাড়া আন্তঃরাজ্য এবং আন্তঃরাষ্ট্র স্তরে অবৈধভাবে কয়লা পাচার হতে পারে, কোনও দায়িত্বশীল মহল তা মেনে নিতে পারেন না। “কয়লা সাম্রাজ্যে” বিচরণ করে কারা প্রভূত সম্পত্তি করায়ত্ত করেছেন, এর নানা রকম তালিকা কখনও কখনও প্রকাশ্যে আসে, কিন্তু এই পর্যন্তই । সত্য ও তথ্য উদঘাটিত হয়নি । প্রকারান্তরে আজও সেই “ট্রাডিশন” সমানে চলছে। প্রগতির চাকা ঘোরাতে, শিল্পের ইন্ধন  মেটাতে, কয়লার যোগান দিতে হবে । এর জন্য সরকারের নির্দিষ্ট বিধি- নিয়ম, আমদানি-রফতানি নীতি রয়েছে, তা সঠিকভাবে কার্যকর না করে ঘুরপথে এ সব করা হচ্ছে কেন ? আসলে কিছু ক্ষমতাবান মানুষের লোভের আগুনে পুড়ে সব কিছুই  ছারখার হচ্ছে ।

Loading

Shankar Dey

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *